সমাজতন্ত্রের কুফরী দিকসমূহ
সমাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে নাস্তিকতার ওপর। ধর্মদ্রোহিতা ও আল্লাহকে অস্বীকার করা হল সমাজতন্ত্রের মূল বুনিয়াদ। তাদের ভাষায়-ধর্ম হল উন্নতির পথে বাধা। দোকান বন্ধ করলে, ব্যবসায় ক্ষতি হয়। হজ্ব আদায়ের দ্বারা শারীরিক দুর্বলতা আসে, কাজ-কর্মে বিঘ্ন ঘটে এবং সম্পদ নষ্ট হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেন দেনে হালাল হারাম বের করলে, অবৈধ উপার্জনের পথ রুদ্ধ করা হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ ইত্যাদি নির্মাণ করলে দেশের জমি নষ্ট করা হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, গোটা দেশটা যেন তাদের। আর ধর্মের অনুসারীরা আবর্জনার বোঝা বৈ কিছুই নয়। সুতরাং, তাদের অধিকারের যেন প্রশ্নই উঠে না।
তাইতো সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘কার্ল মার্কস’ ও তার রূপকার ‘লেনিনের চিন্তা-ধারার সারমর্ম ছিল- “নিখিল বিশ্বে কোন স্রষ্টা বা খোদা বলতে কিছুই নেই। বরং গোটা বিশ্ব জড়পদার্থের পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছে”। কমিউনিষ্টদের দাবি হল, “আমরা যেমনিভাবে পৃথিবীর রাজাদেরকে সিংহাসন থেকে নিচে ফেলে দিয়েছি, তেমনিভাবে আকাশের বাদশাহকেও আরশ হতে নীচে নিক্ষেপ করেছি”। (নাউযুবিল্লাহ)।
জার্মানীর একজন নওমুসলিম ‘মুহাম্মদ আসাদ’ পর্যটক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্বচক্ষে যা অবলোকন করেছেন, তা তিনি নিজের ভাষায় বর্ণনা করেন- সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় বড় পোস্টার ছেপে ষ্টেশন, সড়ক ও টার্মিনালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যার মধ্যে চিত্রাকারে দেখানো হয়েছে যে, একজন সাদা দাড়ি বিশিষ্ট আবা পরিহিত দ্বীনদার ব্যক্তি মেঘাচ্ছন্ন আসমান থেকে নেমে আসছেন, আর মজদুরদের ইউনিফর্ম পরিহিত কমিউনিষ্ট যুবকরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে নীচে অবতরণ করাচ্ছে। এ ছবির নীচে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মজদুরগণ এমনিভাবে খোদাকে আরশ থেকে নীচে নিক্ষেপ করেছে”। (নাউযুবিল্লাহ)। [সূত্র: দি রোড টু মক্কা, পৃষ্ঠা ১৯৯।]
সমাজতন্ত্রের উত্থানের পর রাশিয়ায় আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করার প্রকৃষ্ট নজীর সুস্পষ্ট। তখন রাশিয়ার ৩১ হাজার মসজিদ ও ২৫,৫০০ মাদরাসার অধিকাংশই ধুলিস্যাৎ করে ফেলা হয়। এমনিভাবে রাশিয়ায় অসংখ্য উলামায়ে কিরামের সমাবেশ ছিল। তাদের মধ্য হতে ৫০,০০০ শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরামকে শহীদ করে ফেলা হয়। অবশিষ্টগণ বিভিন্ন দেশে হিজরত করেন। ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায় মুসলমানদের হৃদয়ে দগদগে ঘা হয়ে আছে।
কিন্তু সুদীর্ঘ সত্তর বছর দুর্দান্ত প্রতাপে ক্ষমতা ধরে রেখেও কমিউনিস্টরা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সেখান থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। বস্তুত এ রকম পশুত্ব আর বর্বরতাকে কোন দেশ ও জাতি কোন কালেই সহজে গ্রহণ করেনি। এর প্রমাণ স্বয়ং স্টালিনের ভাষ্য। তিনি মানাটার কনফারেন্সে বর্ণনা করেন- “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও আমাদের এত লোক খতম করতে হয় নি, যত লোক খতম করতে হয়েছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে”।
দৈনিক আঞ্জাম ১৩/১১/৬৭ ইং সংখ্যায় চীনের একজন প্রতিনিধি রিপোর্ট করেন যে, “সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দেড় কোটি জমিদারকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিয়েছি”।
বেশি পিছনে যেত হবে না, হাল জামানার আফগানিস্তান এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার কুখ্যাত লাল ফৌজ সুদীর্ঘ তের বছরে অসংখ্য মুসলমানকে শহীদ করেছে শত শত মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংস করেছে। আজ কমিউনিস্টমুক্ত আফগান এক প্রকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
মোদ্দাকথা সমাজতন্ত্র কখনো ইসলামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং তা ইসলামকে নির্মূল করার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম তাদের চক্ষুশূল। ইসলামকে চিরতরে ধ্বংসের জন্যই কার্লমার্কস, লেলিন প্রমুখ ইয়াহুদী সন্তানরা সমাজতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিল।
সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা মিথ্যা প্রহসনমূলক চালবাজী খাঁটিয়ে তাদের ইজমকে বাজারজাত করতে চায়। তাই কোন দেশে এই পশু ইজমকে চালু করতে হলে, প্রথম স্তরে সমাজতন্ত্রকে ইসলামী ইনসাফ, আদলে ফারূকী ও খিলাফতে রাশিদার যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে জোরদার প্রচারণা চালানো হয়। তাদের এমনও বলতে শোনা যায় যে, ইসলাম আর সমাজতন্ত্রের শিক্ষা এক, অভিন্ন। শুধু নামে মাত্র পার্থক্য। এ স্বার্থমাখা চিত্তাকর্ষক বুলির কারণে অনেক সরল প্রাণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় স্তরে এসে তারা নানাবিধ কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ইসলামের আরকান, ইবাদত ও উলামায়ে কিরামের উপর হালকা হামলা শুরু করে। রেডিও-টেলিভিশন, ড্রামা-পোষ্টার ইত্যাদিতে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি ধর্মীয় বিধানাবলীকে পরিহাসরূপে উপস্থাপন করা হয়। এতে করে যুব সমাজের মনে ইসলামের বিধি বিধান সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
তারা ধর্মীয় জীবনকে মনে করতে থাকে অন্ধত্ব। সমাজের আলেম ও ধর্মানুরাগী মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা সৃষ্টির জন্য সর্বত্র প্রচেষ্টা চালানো হয়। এমনিভাবে কৌশল স্বরূপ চোর-গুন্ডা, বদমায়িশদেরকে দাড়িওয়ালা, পাঞ্চাবী-টুপি পরিহিত অবস্থায় নাট্যানুষ্ঠানে উপস্থাপন করে ধর্মীয় লিবাস-পোশাক ও আচার আচরণের প্রতি জনমনে ঘৃণার সৃষ্টি করা হয়।
তৃতীয় স্তরে তারা জনসাধারণ বিশেষ করে যুব সমাজের মনে উলামায়ে কিরামের প্রতি বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করে।জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তোলে উলামায়ে কিরামের বিরুদ্ধে। নানা কৌশলে তখন দেশের প্রবীণ মুসলমান ও উলামায়ে কিরামকে হত্যা করতে শুরু করে দেয়। ধর্মকে আফিম ধরে ধর্মশালা, মসজিদ, মাদরাসা, ধর্মীয় কিতাব-পত্র সমূলে ধ্বংস করতে শুরু করে। ধর্মকে উৎখাত করতে তারা পাশবিকতা ও বর্বরতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে। দুঃসহ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে শাহাদত বরণ করেন, আর অনেক শেষ সম্বল ঈমানটুকু নিয়ে কোন দেশে হিজরত করতে বাধ্য হন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদ।
সমাজতন্ত্রে বাক স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ করা হয়। ব্যক্তি মালিকানাকে অস্বীকার করা হয়। যার ফলে যাকাত ও হজ্জের মত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিলুপ্ত হয়। কারণ, মালের ব্যক্তি মালিকানা না থাকলে, যাকাত ও হজ্ব কিরূপে বিধিবদ্ধ হবে? তাই সমাজতন্ত্রের মূল থিউরীতে বিশ্বাসী কোন মানুষ মুসলমান থাকতে পারে না। বরং সে ধর্মোদ্রোহী কাফিরে পরিণত হয়। এটাই সমাজতন্ত্রের স্বার্থকতা
দেশ ও জনগণের জন্য শান্তির কোন ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে করতে পারে না, তা আজ বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। সমাজতন্ত্র যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সে সত্য আজ দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। হালের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন এর চাক্ষুষ প্রমাণ।
বর্তমান সভ্যতার দু’টি ভাগ, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। মানবতাবিরোধী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে গুটিকয়েক লোকের হাতে দেশের সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এ কারণেই পুঁজিবাদের চরম পর্যায়ে জন্ম নেয় সমাজতন্ত্র। কাজেই দেখা যায়- পুঁজিবাদ তথা গণতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণেই সমাজতন্ত্রের জন্ম হয়। পুঁজিবাদ তথা গণতন্ত্রের অসারতার পর সমাজতন্ত্র যেহেতু প্রাণহীন লাশ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, আর তার ধ্বজাধারীরা আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান, তারা অনুশোচনা করছে অতীতের ভুলের জন্য। সুতরাং, এ দু’টি মতবাদের কোনটিই মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়। বরং এগুলো বিপর্যয় ও জাতি ধ্বংসের যাঁতাকল মাত্র।
অতএব, একথা সহজেই অনুমেয় যে, ইসলাম বহির্ভূত মানবীর সকল মতবাদ মরীচিকা তুল্য। ইসলাম ব্যতীত কোন রাস্তাই কল্যাণকর নয়। তাই গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের সদল বলে ইসলামের শান্তিময় পতাকা তলে ফিরে আসা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার তাওফীক দান করুন।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islami_jindegi