প্রচলিত জাতীয়তাবাদ ইসলাম বিরোধী
এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ রয়েছে যে, মানব জাতি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করে দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে, যথা-মু‘মিন ও কাফির।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথ দেখান, ঐ সকল লোকদের পথ যাদেরকে আপনি নিয়ামত দান করেছেন। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি আপনার গজব নাযিল হয়েছে। এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। [সূত্র: সূরা ফাতিহা, আয়াত- ৫,৬,৭]
অন্যত্র ইরশাদ করেন-
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُر
অর্থ : বলুন, সত্য আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত! অতএব যার ইচ্ছা ইমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফরী করুক। [সূত্র: সূরা কাহাফ, আয়াত- ২৯]
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ
অর্থ: আল্লাহ তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফির কেউ মু‘মিন। (সূরা তাগাবুন,২)
মূলত : সমগ্র আদম সন্তান পরস্পরে ভাই ভাই এবং সমগ্র পৃথিবীর মানবকুল একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে এবং সূরায় মানব জাতিকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করা এবং ভিন্ন একটি গ্রুপ বা দল সৃষ্টির ভিত্তি হচ্ছে কুফর। যে ব্যক্তি কাফির হলো, সে মানবীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করে দিল। সুতরাং, বুঝা গেল যে, সমগ্র মানব জাতির মধ্যে দল-উপদল সৃষ্টি শুধু ঈমান ও কুফরের ভিত্তিতেই হতে পারে। বর্ণ, ভাষা গোত্র, স্থান ও রাষ্ট্রের মধ্য থেকে কোনটাই মানবীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করতে বা কোন গ্রুপ বা জাতি সৃষ্টি করতে পারে না। একতই বাপের সন্তান যদি বিভিন্ন শহরে বসবাস করে, কিংবা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে অথবা তাদের পরস্পরের গঠন আকৃতি ভিন্ন হয়, তাহলে তাদের এই বর্ণ, ভাষা ও স্থানের বিভিন্নতা সত্ত্বেও তারা পরস্পরে ভাই। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারে না।
জাহিলিয়্যাতের যুগে বংশ গোত্রের বিভিন্নতার উপর ভিত্তি করেই জাতিসত্তার মাঝে বিভিন্নতা সৃষ্টি হত। এমনিভাবে রাষ্ট্র ও এলাকার উপর ভিত্তি করে মানুষেরা জাতি-উপজাতির বিভিন্ন শ্রেণীতে রূপ নিত।
মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে এসব অবাস্তব ভিত্তির মূলোৎপাটন করেন এবং মুসলমান যে কোন দেশের, যে কোন এলাকার, যে কোন গোত্রের এবং যে কোন ভাষাভাষী হোক না কেন, সবাইকে একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন। যেমন, কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-“সমস্ত মু‘মিন পরস্পরে ভাই ভাই” (সূরা হুজুরাত-১০)। এমনিভাবে কাফির যে কোন রাষ্ট্রের বা যে কোন গোত্রেরই হোক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে তারা একই দলভুক্ত বা অভিন্ন যোগসূত্রে গ্রথিত।
হযরত জাবির রা. বর্ণনা করেন, আমরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে এক যুদ্ধে ছিলাম। এ যুদ্ধে বহু সংখ্যক মুহাজির সাহাবী নবীজীর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঙ্গী হলেন। মুহাজিরগণের মধ্যে একজন ছিলেন খুবই রসিক প্রকৃতির। তিনি জনৈক আনসারী সাহাবীর কোমরে হাত দ্বারা হালকা আঘাত করলেন। এতে আনসারী সাহাবী অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, তারা নিজ নিজ গোত্রের লোকদেরকে সাহায্যের জন্য আহবান করতে লাগলেন। অর্থাৎ আনসারী সাহাবী আনসারগণকে আর মুহাজির সাহাবী মুহাজিরগণকে সাহায্যার্থে এগিয়ে আসত আহবান জানালেন। ইতিমধ্যেই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে উপস্থিত হলেন, তিনি বললেন, এটা কেমন জাহিলিয়্যাতের আওয়াজ! [সূত্র: বুখারী, ১ : ৪৯৯]
যে সকল সাহাবী মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তারা হয়েছেন মুহাজির। আর যারা মদীনায় থেকে মুহাজিরগণকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাঁরা হয়েছেন আনসার। এতে দোষের কিছুই নেই। বরং এটা তাদের পরিচিতির জন্য জরুরী। কিন্তু এটাকে ভিত্তি করে কোন ব্যাপারে যখনই তারা দুই দলে বিভক্ত হতে যাচ্ছিলেন, তখনই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুবই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন এবং এটাকে জাহিলিয়্যাত আখ্যা দিয়ে তা বন্ধ করে দিলেন।
পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস এ কথার পক্ষে প্রমাণ বহন করে যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত আদম সন্তানকে শুধু মাত্র কাফির ও মু‘মিন এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিভিন্নতাকে কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ কুদরত ও মানুষের সামাজিক জীবনে পরিচয়ের ক্ষেত্রে এক বিরাট ফায়দার বস্তু বলে বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু আদম সন্তানকে তা জাতিভেদ ও দলভেদের ভিত্তি বানানোর অনুমতি দেননি।
ঈমান ও কুফরের ভিত্তিতে দুই জাতির মধ্যে যে শ্রেণীভেদ সৃষ্টি করা হয়, তা একটি ইচ্ছাধীন বস্তুর উপর নির্ভরশীল। কেননা, ঈমান ও কুফর উভয়টিই মানুষের ইচ্ছাধীন বস্তু। যদি কোন ব্যক্তি এক ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মে শামিল হতে চায় বা বাতিল ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র সহীহ ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করতে চায়, তবে সে অনায়াসেই তার আক্বীদা ও বিশ্বাসকে পাল্টিয়ে উক্ত ধর্মে শামিল হতে পারে। কিন্তু বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, দেশ, ভৌগলিক অবস্থান ও জন্মভূমি প্রভৃতি কোন ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয় যে, সে তার বংশ ও বর্ণকে পাল্টিয়ে দেবে। এ কারণেই কোন ভাষার অধিকারী ও কোন এলাকার বাসিন্দা তাদের ভাষা ও আঞ্চলিকতা পাল্টিয়ে সাধারণত অপর গোত্রের আচার-আচরণ ও ভাষায় সহজেই একাকার হতে পারে না। যদিও সে উক্ত ভাষায় কথা বলতে থাকে এবং উক্ত স্থানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়।
এটাই ইসলামী সৌহার্দ ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বোধ- যা স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কালো-ধবল, আরব-অনারবের অসংখ্য মানুষকে একই সূত্রে গ্রথিত করেছে। যাদের শক্তি সামর্থ্যের মুকাবিলা দুনিয়ার কোন গোত্রই করতে পারেনি। তারা বিরাট ঐক্যসমৃদ্ধ বিশ্বব্যাপী ইসলামী জনবলে বলীয়ান ছিলেন।
অতঃপর মানুষ পুনরায় উক্ত জাতীয়তাবাদের কুসংস্কার ও কু-প্রথাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের মাধ্যমে নিঃশেষিত করে দিয়েছেন। এ সুযোগে পরবর্তীতে, আবার বিধর্মীরা মুসলমানদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন রাষ্ট্র, সীমা-পরিসীমা, ভাষা, বর্ণ, বংশ ও গোত্রে টুকরা টুকরা করে বিভক্ত করে পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত রেখে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে ইসলামের শত্রুদের আক্রমণের পথ সুগম হয়েছে। যার পরিণতি আমরা আজ চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে মুসলমান যারা একই দলভুক্ত ও একটি শরীরের ন্যায় ছিল, তারা আজ ছোট ছোট দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হয়ে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করায় মত্ত হয়েছে। উপরন্তু তাদের মুকাবিলায় সকল তাগুতি শক্তির মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বিধর্মীরা সবাই সম্মিলিত জোটরূপে মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণে মিল্লাতে ওয়াহিদাহ তথা একই দলবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। [সূত্র:মা‘আরিফুল কুরআন, ৮ : ৪৪৯, ৪৬৩]
সুতরাং, এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মুসলমান যে এলাকা বা যে স্থানেই থাকুক, যে ভাষা ও বর্ণভুক্ত হোক, তারা সকলে একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম আঞ্চলিক কিংবা ভাষা বা গোত্রের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। বরং ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বব্যাপী একক জাতীয়তাই হচ্ছে ইসলামের জাতীয়তাবোধ।
আজকের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ যাই বলা হোক না কেন, তা সবই ইসলাম ও মুসলিম জাতীয়তাবোধের পরিপন্থী। কোন মুসলমান তা সমর্থন করতে পারেনা বা তার পক্ষে মদদ যোগাতে পারে না।
সুতরাং, আসুন, পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে চিরতরে বর্জনের পাশাপাশি ইসলাম ও মুসলিম জাতীয়তাবোধের পরিপন্থী কুফরী জাতীয়তাবাদকে এবং ধর্মবিবর্জিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা ও বিদূরিত করে সকলে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে নিরঙ্কুশ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাই। আজ এটাই আমাদের ঈমানের দাবি।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islami_jindegi